ফারজানা ফারাবী, ধর্মীয় ডেক্সঃ ইসলাম মানুষের জীবনে সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও পারিবারিক বন্ধনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। এর মূল ভিত্তিই হলো সিলাতুর রাহিম—আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা। কোরআন-হাদিসে এ বিষয়টি এমনভাবে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যেন বোঝানো হয়—একজন মুসলিমের ঈমান পূর্ণ হতে হলে তাকে আত্মীয়তার চেইন ভাঙা চলবে না।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন—
“আল্লাহকে ভয় করো… এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করো না।” (সূরা আন-নিসা: ১)
এই আয়াত স্পষ্ট নির্দেশ দেয়—আত্মীয়তার যত্ন নেওয়া শুধুমাত্র নৈতিক কর্তব্য নয়; বরং এটি আল্লাহর প্রতি তাকওয়ার একটি বিস্তৃতি।
আরও কঠোর সতর্কবার্তা এসেছে সূরা মুহাম্মদে—
“যারা আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তাদের অভিশাপ দেন।” (সূরা মুহাম্মদ: ২২–২৩)
এই আয়াত জানিয়ে দেয়—সম্পর্ক ভাঙা আল্লাহর অসন্তুষ্টির অন্যতম কারণ।
রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্ক বজায় রাখাকে দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। সহিহ বুখারির বিখ্যাত হাদিস—
“যে ব্যক্তি চায় তার রিজিক বৃদ্ধি হোক এবং আয়ু দীর্ঘ হোক, সে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করুক।”
অর্থাৎ সিলাতুর রাহিম কেবল একটি আধ্যাত্মিক ইবাদত নয়; এটি মানুষের জীবিকা, সুস্বাস্থ্য ও আয়ুর ওপর বরকত এনে দেয়।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিসে তিনি বলেন—
“সত্যিকারের সম্পর্ক রক্ষাকারী সে নয়, যে ভালো ব্যবহার করলে ভালো ব্যবহার করে। বরং সে-ই প্রকৃত সিলাতুর রাহিমকারী, যে সম্পর্ক ছিন্নকারীর সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখে।” (সহিহ বুখারি)
আজকের যুগে এই শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ক্ষুদ্র অভিমান, একটুখানি ভুল বুঝাবুঝি বা সামাজিক অবস্থানগত ভিন্নতার কারণে আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ইসলামের নির্দেশ—যে সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছে, তার সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে ধৈর্য ও নৈতিকতার মাধ্যমে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে যে দায়িত্বগুলো রয়েছে, সেগুলোর পরিধিও বিস্তৃত—
অভাব-অসুবিধায় সাহায্য করা
খোঁজখবর নেওয়া
অন্যায়ে না জড়ানো, কিন্তু উপদেশ দেওয়া
দুঃসময়ে পাশে থাকা
আর্থিক প্রয়োজন হলে সাহায্য করা
ক্ষমা করা—এমনকি নিজের অহংকার বিসর্জন দিয়েও
ইসলাম জানায়—আল্লাহর রহমত যাদের উপর বর্ষিত হয়, তারা অন্যদের প্রতি দয়া করে; তার শিকড় পরিবার থেকেই শুরু হয়।
রাসূল ﷺ আরও সতর্ক করে বলেছেন—
“আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (সহিহ মুসলিম)
এ হাদিস মুসলিম সমাজকে সতর্ক করে—শুধু নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত যথেষ্ট নয়—মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক এবং আত্মীয়দের প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণ করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
পরিবারে শান্তি—সমাজে সম্প্রীতি—এ দুটোর ভিত্তিই পারস্পরিক সম্পর্ক। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবারিক বিভাজন, মানসিক চাপ, একাকিত্ব এবং সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ আত্মীয়তার সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যাওয়া। অথচ ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করলে এই বিচ্ছিন্নতা কমে, মানুষ একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হয়, সমাজ শক্তিশালী হয়।
এসব শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—
ইসলাম শুধু আল্লাহর ইবাদত শেখায় না; বরং মানুষের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও সহযোগিতাকেও ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
আজ শুক্রবারের এই বিশেষ প্রতিবেদনের সারকথা—
ব্যস্ততা, ক্ষুদ্র ভুল বোঝাবুঝি বা সামান্য অভিমান যেন আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্কগুলোকে দুর্বল না করে। কোরআন-হাদিসের নির্দেশ হলো—
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মীয়তার বন্ধনকে অটুট রাখা। যারা এই সম্পর্ক রক্ষা করে—আল্লাহ তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের দরজা খুলে দেন।