এম.হোসাইন আহমদ, বিশেষ প্রতিবেদনঃ ব্রাহ্মণপাড়ার বাতাসে আজকাল একটা কথা ছড়িয়ে গেছে—
“মানুষ যদি আলো দিতে চায়, তাকে কোনো দেশের সীমান্ত আটকে রাখতে পারে না।”
এই কথার সবচেয়ে জীবন্ত ব্যাখ্যা একজন মানুষ—মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী।
একজন প্রবাসীর গল্প আমরা সাধারণত শুনি প্রবাসের সংগ্রাম, টিকে থাকার যুদ্ধ, নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। কিন্তু মোশাররফ হোসেনের গল্পটি ভিন্ন, সম্পূর্ণ আলাদা এক মানচিত্র।
তার গল্পে প্রবাস আছে, পরিশ্রম আছে, আছে সংগ্রামের দীর্ঘ দিন-রাত— কিন্তু তার প্রতিটি ঘামে লেখা আছে জন্মভূমির ভবিষ্যৎ, গ্রামের স্কুলের শিশুদের হাসি, একদিন আরও আলোকিত হবে আমার এলাকা—এই একটিই সংকল্প।
বহু মানুষ জীবনে সম্পদ গড়ে, বাড়ি গড়ে, কারও কারও স্বপ্ন শেষ হয় নিজের আরামেই। কিন্তু মোশাররফ হোসেনের স্বপ্ন থেমে থাকেনি তার ঘরে;
তিনি স্বপ্ন দেখেছেন গ্রামের ঘরগুলোতে আলো ছড়ানোর। এ কারণেই ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষ তাকে আজ ডাকেন—“আমাদের আলোর ফেরিওয়ালা।”
শৈশবের প্রথম পাঠ—কষ্টের মধ্যেই আলো থাকে
১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর, ধান্যদৌল গ্রামে জন্ম নেওয়া এক শিশু জানত না যে একদিন পুরো এলাকার ইতিহাসে তার নাম আলোর রেখা হয়ে থাকবে। কয়েক বছর পর, ১৯৭৪ সালে বাবার মৃত্যু যেন শৈশব থেকে তাকে হঠাৎ বড় করে দিলো।
ছোট্ট ছেলেটিকে তখন ছয় ভাইবোনের দায়িত্ব নিতে হয়। চোখের সামনে দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতা, শিক্ষার অভাব, গ্রামের মানুষজনের সংগ্রাম—
এসব দেখে খুব অল্প বয়সেই তার মনে জন্ম নেয় এক প্রশ্ন: “এই এলাকার মানুষ কি কোনো দিন ভালোভাবে পড়তে পারবে না?”
হ্যাঁ, তখনই তার ভেতরে জন্ম নেয় সেই আগুন—
যা পরে তাকে প্রবাসের রাস্তায় পাঠায়,
আর সেই আগুনই তাকে ফিরিয়ে আনে জন্মভূমিতে শিক্ষা ও মানবিকতার আলো ছড়িয়ে দিতে।
স্বপ্নের পথ প্রবাসে শুরু—নিউইয়র্কের রাস্তায় ব্যস্ত দিন, দেশের জন্য ব্যস্ত রাত, উচ্চমাধ্যমিক শেষে জীবিকার কষ্ট তাকে ঠেলে দেয় বিদেশযাত্রায়।
নিউইয়র্ক—বিশাল শহর, অর্থের পেছনে দৌড়ানো মানুষ, কে কোথায় যাচ্ছে কেউ কারো খোঁজ রাখে না। এই শহরের রাস্তায় ট্যাক্সিক্যাব চালাতে চালাতেই তিনি বুঝলেন— প্রবাসে টিকে থাকা মানে কেবল রোজগার নয়, মানে ভেতরের শক্তি জাগিয়ে তোলা।
নির্মাণ কাজে, ছোট ব্যাবসায়, বহু কঠোর পরিশ্রমে যখন একটু একটু করে অর্থ সঞ্চয় হচ্ছিল—
তার মাথায় তখন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা নয়, বরং জন্মভূমির শিক্ষার ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন।
প্রতিটি ডলার আয় করতেন যখন, মনে মনে ভাবতেন— “এই টাকায় আমার গ্রামের একটি শিশুর খাতা-কলম হবে।” “এই টাকায় একটি স্কুলের একটা কক্ষ দাঁড়াবে।” প্রবাসের অচেনা শহর তাই তার কাছে হয়ে উঠেছিল নিজের গ্রামের স্বপ্ন সঞ্চয়ের ভাণ্ডার।

গ্রামের বুকে শিক্ষার বৃক্ষ—যার ছায়ায় বেড়ে উঠছে প্রজন্ম
স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে সময় লাগে,
কিন্তু তার স্বপ্নগুলো কখনোই থেমে থাকেনি।
১৯৮৯: প্রথম স্বপ্ন—আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়
ধান্যদৌল গ্রামে যখন এই বিদ্যালয় দাঁড়াল, মানুষের চোখে অবিশ্বাস।
এক প্রবাসী ছেলে নিজের কষ্টের টাকায় গ্রামে স্কুল বানিয়েছে—
এমন ঘটনা আধুনিক যুগেও বিরল।
১৯৯৮: উচ্চশিক্ষার আলো—মোশাররফ হোসেন খান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
রাজৎগাড়ার বুক চিরে যখন কলেজটির ভবন দাঁড়ালো, এলাকার মা-বাবারা প্রথমবার বিশ্বাস করলেন—
“আমাদের সন্তানরাও এখন অনার্স পড়তে পারবে, দূরে যেতে হবে না।”
আজ এখানে প্রায় ৩,০০০ শিক্ষার্থী, ১০টি বিষয়ে অনার্স কোর্স।
নারী শিক্ষার স্বপ্ন—আবদুল মতিন খসরু মহিলা কলেজ
এখন ৫,০০০-এরও বেশি তরুণী এখানে পড়াশোনা করছে।
গ্রামের মেয়েরা যেখানে একসময় উচ্চশিক্ষার কথা ভাবতেই ভয় পেত,
আজ তারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কলেজে যাচ্ছে।
২০০২: শিশুশিক্ষার ভিত্তি—মম রোমন কিন্ডারগার্টেন
এখানে প্রায় ৩,০০০ শিশুর প্রথম পাঠ শুরু হয়।
এছাড়া মাদ্রাসা, লাইব্রেরি, পাঠাগার—
এগুলো শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, সমাজের আত্মাকে জাগিয়ে তোলার কেন্দ্র।
স্বাস্থ্যসেবায় মানবিক হাত—হাসপাতালের জমি দান
২০১০ সালে কুমিল্লার ডায়াবেটিক হাসপাতালের জন্য তিনি দান করেন পুরো ১ বিঘা জমি।
চিকিৎসার অভাবে যারা ভুগতেন, তাদের জন্য এই হাসপাতাল আজ আশীর্বাদ।
মসজিদ নির্মাণে দান, গরিবদের আর্থিক সহায়তা—এসব তার জীবনের নিয়ম।
তিনি বলেন,
“মানুষ মানুষের জন্য। আমি যদি আমার অর্থ মানুষের কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে সেই অর্থের মান কোথায়?”
প্রবাসেও দেশের গর্ব—সুবর্ণজয়ন্তীর সম্মাননা
২০২৫ সালের ২ নভেম্বর নিউইয়র্কের “ট্যারেস অন দ্য পার্ক”-এ
বাংলাদেশ সোসাইটি ইনক.’র সুবর্ণজয়ন্তীতে
মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীকে
“শিক্ষা ও মানবিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান”—এ সম্মাননা দেওয়া হয়।
মঞ্চে উঠে তিনি বলেন,
“এই পুরস্কার আমার না।
এটি আমার এলাকার প্রতিটি শিশুর, প্রতিটি মায়ের, প্রতিটি পরিবারের।
আমি তো শুধু তাদের হাত ধরে একটু আলো দেখিয়েছি।”
স্বপ্ন দেখা তার নেশা—উন্নয়ন তার ধ্যানজ্ঞান
প্রবাসে থেকেও তিনি প্রতিদিন ভাবেন—
“আমার এলাকায় কী করলে আরও উন্নতি হবে?”
“কোন বিদ্যালয়ে নতুন ভবন দরকার?”
“কোন মেধাবী ছাত্র অর্থাভাবে পিছিয়ে আছে?”
এই প্রশ্নগুলোই তার আনন্দ, তার নেশা।
ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষ যেভাবে দেখেন তাকে
যে কোনো চায়ের দোকানে গেলেই শোনা যায়—
“আমাদের এলাকা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, এর অর্ধেকও হতো না যদি মোশাররফ সাহেব না থাকতেন।”
একজন স্কুলছাত্র বলে,
“আমি যদি ভালো চাকরি পাই একদিন, সেটা হবে মোশাররফ স্যারের কারণে।”
একজন মা বলেন,
“আমার মেয়ে আজ কলেজে যায়, এটা তার কারণেই সম্ভব হয়েছে।”
এমন ভালোবাসা টাকা দিয়ে কেনা যায় না—
এটি পাওয়া যায় নিঃস্বার্থ কাজের বদলে।
মোশাররফ হোসেন খান—একটি নাম নয়, একটি আন্দোলন
তিনি প্রচারণায় বিশ্বাসী নন।
তিনি বিশ্বাস করেন—শিক্ষা হলো মানবিকতার সবচেয়ে বড় ভাষা।
তিনি প্রমাণ করেছেন—
গ্রামের উন্নয়ন কোনো সরকার একা করতে পারে না,
কিন্তু একজন মানুষ চাইলে একটি যুগের মানচিত্র বদলে ফেলতে পারে।
তার কাজ নিভৃতে হলেও, তিনি তৈরি করেছেন একটি সাম্রাজ্য—
যার নাম শিক্ষা,
যার ভিত্তি মানবিকতা,
যার শক্তি দেশপ্রেম।
শেষ কথা—তিনি সত্যিই আলোর ফেরিওয়ালা
ব্রাহ্মণপাড়ার সন্ধ্যায় যখন আজানের ধ্বনি শোনা যায়,
যখন স্কুলছাত্ররা ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফেরে,
তখন সেই পুরো এলাকার প্রতিটি ধুলিকণায় লুকিয়ে আছে
মোশাররফ হোসেন খানের দশকের পর দশক শ্রম, ভালোবাসা আর স্বপ্ন।
তিনি প্রমাণ করেছেন—
একজন মানুষ যদি নিজের জন্মভূমিকে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা নেয়,
তবে সে মানুষই পারে একটি প্রজন্মকে আলো দেখাতে।
হ্যাঁ—তিনি আলোর ফেরিওয়ালা।
প্রবাসের রোদে পোড়া দুই হাতে তিনি তুলে এনেছেন জন্মভূমির জন্য আলো।
এ আলো আগামী প্রজন্ম বহন করবে, সমাজকে বদলে দেবে, দেশকে এগিয়ে দেবে।